বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে যাকাত শুধু একটি ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং এটি সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক অনন্য উপায়। যাকাতের মধ্যে স্বর্ণ ও রূপার যাকাত বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ অধিকাংশ পরিবারেই স্বর্ণালঙ্কার ও রূপার সংরক্ষণ প্রচলিত। ২০২৪ সালের জন্য কত ভরি স্বর্ণ থাকলে যাকাত দিতে হয়, যাকাত দেওয়ার নিয়ম, নিসাব, বণ্টনের খাত-সবকিছু নিয়ে এই ব্লগে থাকছে বিস্তারিত আলোচনা।
আর্টিকেলের ভিতরে যা রয়েছে
- 1 যাকাত কী ও কেন?
- 2 স্বর্ণ ও রূপার যাকাত: নিসাব ও হিসাব
- 3 ১ লাখ টাকায় যাকাত কত ২০২৪?
- 4 সর্বনিম্ন কত টাকা থাকলে যাকাত দিতে হবে?
- 5 কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ?
- 6 যাকাতের নিসাব ও বন্টনের খাত
- 7 যাকাতের-নিসাব-ও-বন্টনের-খাত
- 8 যাকাত বন্টনের খাত কয়টি ও কি কি
- 9 যাকাতের ফরজ কয়টি ও কি কি
- 10 যাকাত হিসাব করার সহজ পদ্ধতি
- 11 উদাহরণ: যাকাত ক্যালকুলেশন
- 12 যাকাতের সময় ও দেওয়ার নিয়ম
- 13 সাধারণ প্রশ্নোত্তর
- 13.1 স্বর্ণ ও রূপার যাকাত কখন ফরজ হয়?
- 13.2 স্বর্ণ ও রূপার যাকাতের হার কত?
- 13.3 স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহারের জন্য থাকলেও কি যাকাত দিতে হবে?
- 13.4 স্বর্ণ ও রূপার যাকাত কিভাবে হিসাব করবো?
- 13.5 যাকাতের নিসাব কিভাবে নির্ধারণ হবে?
- 13.6 যাকাত কাদেরকে দিতে পারি?
- 13.7 ব্যাংকে রাখা টাকার যাকাত দিতে হবে কি?
- 13.8 স্বর্ণ ও রূপার যাকাত কি শুধু রমজানে দিতে হবে?
- 13.9 যাকাতের টাকা আত্মীয়কে দেওয়া যাবে কি?
- 13.10 স্বর্ণ ও রূপার যাকাত কিভাবে প্রদান করবো?
- 14 যাকাতের গুরুত্ব ও সামাজিক প্রভাব
- 15 সংক্ষেপে-মূল পয়েন্ট
- 16 শেষ কথা
যাকাত কী ও কেন?
যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। এটি ফরজ ইবাদত, যা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিকদের জন্য বাধ্যতামূলক। যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হলো ধন-সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সমাজের দরিদ্রদের সহায়তা করা।
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত: নিসাব ও হিসাব
কত ভরি স্বর্ণ থাকলে যাকাত দিতে হয় ২০২৪?
২০২৪ সালে বাংলাদেশে স্বর্ণের যাকাতের নিসাব নির্ধারিত হয়েছে ৭.৫ ভরি (প্রায় ৮৭.৪৮ গ্রাম) স্বর্ণ বা ৫২.৫ ভরি (প্রায় ৬১২.৩৬ গ্রাম) রূপা। অর্থাৎ, যদি কারো কাছে মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই পরিমাণ স্বর্ণ বা রূপা থাকে এবং তা এক বছর ধরে সংরক্ষিত থাকে, তাহলে তার উপর স্বর্ণ ও রূপার যাকাত ফরজ হবে।
- স্বর্ণের নিসাব: ৭.৫ ভরি (৮৭.৪৮ গ্রাম)
- রূপার নিসাব: ৫২.৫ ভরি (৬১২.৩৬ গ্রাম)
এছাড়া, যদি কারো কাছে স্বর্ণ, রূপা, নগদ অর্থ, বা ব্যবসায়িক পণ্য-সব মিলিয়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তাহলেও যাকাত ফরজ হবে।
যাকাত দেওয়ার নিয়ম ২০২৪
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত হিসাবের নিয়ম খুবই সহজ। নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে থাকলে, মোট মূল্যের ২.৫% হারে যাকাত দিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার কাছে ১০ লাখ টাকার স্বর্ণ থাকে, তাহলে যাকাত হবে ২৫,০০০ টাকা (১০,০০,০০০ × ২.৫%)।
১ লাখ টাকায় যাকাত কত ২০২৪?
১ লাখ টাকায় যাকাতের পরিমাণ হবে ২,৫০০ টাকা (১,০০,০০০ × ২.৫%)।
সর্বনিম্ন কত টাকা থাকলে যাকাত দিতে হবে?
যাকাতের জন্য সর্বনিম্ন সম্পদের পরিমাণ (নিসাব) নির্ধারিত হয় রূপার মূল্যে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ৫২.৫ ভরি রূপার সমমূল্য টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হবে। বর্তমানে এই পরিমাণ রূপার মূল্য আনুমানিক ৬৬,০০০ থেকে ৭২,০০০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ, যদি আপনার কাছে মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই পরিমাণ টাকা বা সমমূল্যের সম্পদ থাকে, তাহলে যাকাত দিতে হবে।
কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ?
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত ছাড়াও যেসব সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হয়:
- নগদ অর্থ (ক্যাশ, ব্যাংক ব্যালান্স)
- ব্যবসায়িক পণ্য
- শেয়ার, স্টক, মিউচুয়াল ফান্ড
- কৃষিজাত দ্রব্য
- গবাদি পশু (গরু, ছাগল, উট ইত্যাদি)
- খনিজ দ্রব্য
তবে, মৌলিক প্রয়োজনের জন্য ব্যবহৃত বাড়ি, গৃহস্থালি জিনিসপত্র, ব্যক্তিগত গাড়ি, ব্যবহৃত পোশাক ইত্যাদির উপর যাকাত ফরজ নয়।
যাকাতের নিসাব ও বন্টনের খাত
যাকাতের-নিসাব-ও-বন্টনের-খাত
যাকাতের নিসাব হলো শরীয়ত নির্ধারিত সর্বনিম্ন সম্পদের পরিমাণ, যার মালিক হলে যাকাত ফরজ হয়। যাকাত বন্টনের খাতগুলো নির্ধারিত রয়েছে কুরআনে।
যাকাত বন্টনের খাত কয়টি ও কি কি
কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী, যাকাত বন্টনের খাত মোট ৮টি। এগুলো হলো:
- ফকির (যার কোনো সম্পদ নেই)
- মিসকীন (যার সামান্য সম্পদ আছে)
- যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী
- নতুন মুসলিম
- ক্রীতদাস মুক্তির উদ্দেশ্যে
- ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি
- আল্লাহর পথে জিহাদে রত ব্যক্তি
- মুসাফির (অভাবগ্রস্থ ভ্রমণকারী)
এছাড়া, যাকাতের অর্থ এই আট খাতের বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বৈধ নয়।
যাকাতের ফরজ কয়টি ও কি কি
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে:
- মুসলিম হতে হবে
- স্বাধীন হতে হবে
- নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে
- সম্পদ এক বছর ধরে থাকতে হবে
- সম্পদ বৃদ্ধি ও লাভজনক হতে হবে
যাকাত হিসাব করার সহজ পদ্ধতি
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত হিসাব করতে চাইলে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:
- নিজের কাছে থাকা স্বর্ণ, রূপা, নগদ টাকা, ব্যাংক ব্যালান্স, ব্যবসায়িক পণ্যের বাজারমূল্য যোগ করুন
- মৌলিক প্রয়োজনের জন্য ব্যবহৃত সম্পদ বাদ দিন
- নিসাব পরিমাণ (৫২.৫ ভরি রূপার সমমূল্য) ছাড়িয়ে গেলে মোট টাকার ২.৫% যাকাত দিন
উদাহরণ: যাকাত ক্যালকুলেশন
ধরা যাক, আপনার কাছে আছে:
- স্বর্ণ: ৮ ভরি (বর্তমান বাজারমূল্য ১,২০,০০০ টাকা/ভরি, মোট ৯,৬০,০০০ টাকা)
- নগদ টাকা: ৫০,০০০ টাকা
- ব্যবসায়িক পণ্য: ১,০০,০০০ টাকা
মোট = ৯,৬০,০০০ + ৫০,০০০ + ১,০০,০০০ = ১১,১০,০০০ টাকা
যাকাত = ১১,১০,০০০ × ২.৫% = ২৭,৭৫০ টাকা
যাকাতের সময় ও দেওয়ার নিয়ম
- চন্দ্র বছরের হিসাব অনুযায়ী, নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে থাকলে যাকাত ফরজ হয়
- যাকাত নগদ অর্থ, খাদ্য, পোশাক অথবা প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে দেওয়া যায়
- যাকাত অবশ্যই উপযুক্ত খাতে বণ্টন করতে হবে
সাধারণ প্রশ্নোত্তর
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত কখন ফরজ হয়?
যখন কারো কাছে ৭.৫ ভরি (৮৭.৪৮ গ্রাম) স্বর্ণ বা ৫২.৫ ভরি (৬১২.৩৬ গ্রাম) রূপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ এক বছর ধরে থাকে, তখন যাকাত ফরজ হয়।
স্বর্ণ ও রূপার যাকাতের হার কত?
স্বর্ণ ও রূপার যাকাতের হার হলো মোট সম্পদের ২.৫%।
স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহারের জন্য থাকলেও কি যাকাত দিতে হবে?
যদি স্বর্ণালঙ্কার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয় এবং নিসাব পরিমাণে থাকে, তাহলে যাকাত দিতে হবে।
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত কিভাবে হিসাব করবো?
আপনার কাছে থাকা স্বর্ণ ও রূপার বর্তমান বাজারমূল্য নির্ধারণ করুন, তার সাথে নগদ অর্থ ও অন্যান্য সম্পদ যোগ করুন, মোটের ২.৫% যাকাত দিন।
যাকাতের নিসাব কিভাবে নির্ধারণ হবে?
রূপার বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী ৫২.৫ ভরি রূপার সমমূল্যের সম্পদ থাকলে যাকাত ফরজ হবে।
যাকাত কাদেরকে দিতে পারি?
যাকাত কেবলমাত্র কুরআনে নির্ধারিত ৮টি খাতে দেওয়া যাবে, যেমন- ফকির, মিসকীন, ঋণগ্রস্থ, মুসাফির ইত্যাদি।
ব্যাংকে রাখা টাকার যাকাত দিতে হবে কি?
হ্যাঁ, ব্যাংকে রাখা টাকাও যাকাতযোগ্য সম্পদের মধ্যে পড়ে, নিসাব পরিমাণ থাকলে ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত কি শুধু রমজানে দিতে হবে?
যাকাতের নির্দিষ্ট কোনো মাস নেই, তবে অনেকেই বরকতের আশায় রমজানে দিয়ে থাকেন। যেদিন নিসাব পরিমাণ সম্পদের এক বছর পূর্ণ হবে, সেদিনই যাকাত আদায় করা উত্তম।
যাকাতের টাকা আত্মীয়কে দেওয়া যাবে কি?
যদি আত্মীয় যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত (ফকির/মিসকীন) হয় এবং সে নিজের পরিবারের সদস্য না হয় (যেমন- বাবা-মা, সন্তান, স্ত্রী/স্বামী ছাড়া), তাহলে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত কিভাবে প্রদান করবো?
আপনি নগদ অর্থ, স্বর্ণ/রূপা বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী হিসেবেও যাকাত দিতে পারেন, তবে তা অবশ্যই শরীয়ত নির্ধারিত খাতে দিতে হবে।
যাকাতের গুরুত্ব ও সামাজিক প্রভাব
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, এটি সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য আশীর্বাদ। যাকাতের অর্থে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আসে, দারিদ্র্য কমে, এবং সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়।
সংক্ষেপে-মূল পয়েন্ট
- স্বর্ণ ও রূপার যাকাত ফরজ হয় ৭.৫ ভরি স্বর্ণ বা ৫২.৫ ভরি রূপা বা সমমূল্যের সম্পদের মালিক হলে
- যাকাতের হার ২.৫%
- নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে থাকলে যাকাত ফরজ
- যাকাতের ৮টি নির্দিষ্ট খাত রয়েছে
- ১ লাখ টাকায় যাকাত ২,৫০০ টাকা
- যাকাতের হিসাব সহজেই নিজে করতে পারেন
শেষ কথা
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত আদায় করে আপনি যেমন নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করছেন, তেমনি সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ২০২৪ সালে নির্ভুলভাবে যাকাত হিসাব করুন, যথাযথ খাতে তা বণ্টন করুন, এবং সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখুন।
আপনার যাকাতের হিসাব, নিয়ম, নিসাব বা বণ্টন নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন বা আপনার মতামত শেয়ার করুন। এই ব্লগটি শেয়ার করুন, যাতে আরও মানুষ সঠিকভাবে স্বর্ণ ও রূপার যাকাত আদায় করতে পারে।
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত-এটি শুধু ইবাদত নয়, এটি মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।